মিরসরাই : মুহাম্মদ দিদারুল আলম, (নিজস্ব প্রতিনিধি): গুই সাপকে শত্র“ বলে গণ্য করে এদের প্রাণে মেরে ফেলার প্রবণতা বেশি গ্রামীণ জনপদে। কিন্তু গুই সাপ কখনওই মানুষের ক্ষতিসাধন করে না। উপরন্তু পরিবেশ রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রাখছে এই প্রাণীটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুই সাপের বিচরণ থাকলেও বাংলাদেশে এটি অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারা পৃথিবীতে ৭৩ প্রজাতির গুই সাপ রয়েছে। আর বাংলাদেশে রয়েছে তিনটি প্রজাতি। এই তিন প্রজাতির গুই সাপের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Varanus
bengalensis,Varanus flavescens Ges Varanus
salvator. বাংলাদেশে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম ও সিলেটে গুই সাপের বিচরণ রয়েছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে
Varanus
flavescens প্রজাতির গুই সাপ রয়েছে। অথচ এই প্রজাতির গুই সাপ সর্বোচ্চ বিলুপ্তি ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে ২০০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব ন্যাচার (আইইউসিএন) এই প্রজাতির গুই সাপকে বিলুপ্তি ঝুঁকিপূর্ণ প্রাণী হিসেবে তালিকাভূক্ত করে।
বাংলাদেশ ছাড়াও গুই সাপ পাওয়া যাবে ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। প্রাণী গবেষকদের মতে, পরিবেশের একটি মাংশাসী প্রাণী হিসেবে বস্তুসংস্থানে অথবা প্রকৃতির খাদ্য শৃঙ্খলে অনন্য ভূমিকা রাখছে গুই সাপ। এ ছাড়া বিভিন্ন পঁচা আবর্জনা, মৃত প্রাণী ভক্ষণ করে এটি পরিবেশ দূষণের হাত থেকে প্রকৃতিকে রক্ষা করে। অথচ অসচেতনতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে দিন দিন এদের সংখ্যা কমছে আশংকাজনকভাবে।
বাংলাদেশে গুই সাপ ঝুঁকির অন্যতম কারণ ব্যাপকহারে এদের প্রজনন ক্ষেত্র এবং আবাসস্থল ধ্বংস। এ ছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গুই সাপের চামড়া আহরণ করে। বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্য মতে, ১৯৭৮-১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫১ লাখ ৪৩ হাজার টাকার চামড়া রপ্তানি হয়। গুই সাপের চামড়া রপ্তানির ফলে পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাবের বিবেচনায় ১৯৯০ সালে সরকার এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
দেশের বিশিষ্ট বন্য প্রাণী গবেষক সাজিদ আলী হাওলাদার বিভিন্ন আশংকার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘গবেষণায় প্রাপ্ত বাংলাদেশে তিন প্রজাতির গুই সাপেরই বিচরণ রয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। ব্যাপকহারে বন উজাড় আর অহেতুক নানা কুসংস্কারের কারণে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অযথা ভয় পেয়ে মেরে ফেলে গুই সাপকে। এমনকি ঘনহারে পুকুর-ডোবা, জমি, খাল-বিল ভরাটের ফলে ওরা বাসস্থল হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
বাংলায় এর আভিধানিক নাম সোনা গুই অথবা গুই সাপ হলেও স্থানীয়ভাবে এর আরও একটি নাম রয়েছে। মিরসরাই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ‘গুল’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত এ প্রাণীটি। সাধারণ সাপ থেকে কিছুটা ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ গুই সাপের রয়েছে চারটি পা। পায়ে রয়েছে সম-পরিমাণ আঙ্গুল। অনেকটা কালচে রঙের পিঠে রয়েছে ডোরাকাটা দাগও। লেজখানা কিছুটা লম্বাকৃতিরও বটে। পুরো গুই সাপের দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় থেকে তিন ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মিরসরাই উপজেলার উপকূলীয় চরাঞ্চলে বিপুল সংখ্যক গুই সাপের বিচরণ রয়েছে। ২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও চার কিলোমিটার প্রস্থের ম্যানগ্রোভ বনটিতে এখনও অসংখ্য গুই সাপ ঘোরাফেরা করছে। বন ছাড়াও পাশ্ববর্তী চরে এ প্রাণীর দেখা মিলবে খুব সহজে। বামনসুন্দর, মুহুরী প্রকল্প, ইছাখালী, সাহেরখালীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গুই সাপের দেখা মিলেছে।
উন্নয়ন সংগঠক ও পরিবেশবিদ শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এখন থেকে ১০ বছর পূর্বেও মিরসরাই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ গুই সাপ দেখা যেত। এখন রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ায় গুই সাপ মারা যাচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র বিপন্নের আশংকায় রয়েছে।’
উপজেলার বামনসুন্দর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ মামুন এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘গুই সাপের কোন ইতিবাচক গুণাগুনের কথা আমি জানি না। পাড়ার লোকজন দেখামাত্রই নানা প্রজাতির সাপের মত এ জাতের সাপকেও মেরে ফেলে।’ চরাঞ্চলে অন্যান্য সাপের তুলনায় গুই সাপের সংখ্যা অনেক বেশি উল্লেখ করে মামুন আরও বলেন, ‘উপকূলীয় বনাঞ্চলে যখন জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে যাই, তখন একাধিক গুই সাপের সঙ্গে দেখা হয়।’ চরশরৎ এলাকার বাসিন্দা রশিদ আহম্মদ বলেন, ‘আমরা দেখামাত্রই সাপ মারতে উদ্যত হই। কিন্তু কোন সাপ কোন উপকারে আসে না আসে এতকিছু আমরা বুঝি না।’
ইছাখালী এলাকার কৃষক জহুরুল হক এ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘কৃষিজমিতে চাষাবাদের সময় মাঝে-মধ্যে গুই সাপ চোখে পড়ে। যেহেতু এ জাতীয় সাপগুলো মানুষের কোন ক্ষতিসাধন করে না, তাই আমরা এর প্রতি বিরক্ত হই না। তবে দুষ্টু মানুষের খপ্পরে পড়লে জান শেষ- এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।’এসময় মনিরুল ইসলাম নামে অপর কৃষক বলেন, ‘আমরা না মারলেও গুই সাপ অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। কারণ তাদের বংশবিস্তারে নানা রকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’